১১ই আশ্বিন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ| ২৬শে সেপ্টেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ| ১১ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৫ হিজরি| রাত ১:৫৬| শরৎকাল|
Title :
ময়মনসিংহের ফুলপুরে ৬০পিস ইয়াবা সহ গ্রেফতার ১। রাস্তার বেহাল অবস্তায় সাধারণ মানুষের চলাফেরার ভোগান্তির শেষ নেই। জিকে গউছের মুক্তির দাবীতে চুনারুঘাট উপজেলা বিএনপির বিক্ষোভ মিছিল সাবেক এমপি জালাল উদ্দিন তালুকদারের ১১তম মৃত্যুবার্ষিকী পালিত দুর্গাপুরে রুসার আয়োজনে বিনামূল্যে চক্ষু চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম উদ্বোধন বালিয়াডাঙ্গীতে আইন শৃঙ্খলা ও সন্ত্রাসী নাশকতা প্রতিরোধ কমিটির মাসিক সভা অনুষ্ঠিত পূর্বধলায় ভারতীয় মদসহ দুই মাদক ব্যবসায়ী আটক নাগরপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের পরিচিতি সভায় নাগরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগ নোয়াখালীতে যুবলীগ নেতাকে গলা কেটে হত্যা, ইয়াবাসহ প্রধান আসামি গ্রেফতার সাফ অনূর্ধ্ব-১৭ ফুটবলার চিশতীকে ইউএনও’র ফুলেল শুভেচ্ছা

শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবার এবং আমাদের দায়

এবিএম সালেহ উদ্দীন
  • Update Time : মঙ্গলবার, ডিসেম্বর ১৪, ২০২১,
  • 46 Time View

১৯৭১ সাল। স্বাধীন বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের বছর। একাত্তরের প্রতিটি দিন ও সময় ছিল ভয়াল আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠাময়। স্বপ্নময় প্রত্যাশা, সম্ভাবনা ও পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত একটি স্বাধীন রাষ্ট্র বিনির্মাণের সংকল্পে সমগ্র বাংলার (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) জনগণ এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।

তৎকালীন পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মৌলিক অধিকার কেড়ে নিয়ে পশ্চিমা হানাদার বাহিনী এতই হিংস্র হয়ে উঠেছিল যে পৃথিবীতে এ ধরনের নৃশংসতাকে হিটলারের সাথে তুলনা করা যায়। একাত্তরের ২৫ মার্চ পাক হানাদারদের অমানবিকতা ও গণহত্যা ইতিহাসের একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক ২৫ মার্চের ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যার বিভীষিকাময় চিত্র বিশ্বের গণমাধ্যমসমূহে প্রচারিত হয়েছিল।

বলা বাহুল্য, দীর্ঘদিনের শোষণ, নিপীড়নে স্বাধীনতাসংগ্রাম ও স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত পর্যায়ে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় সাধারণ জনগণের ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্যাতন ও নিপীড়নের চিত্র দেখে বিশ্বের অনেক রাষ্ট্র বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন জানায়।

দীর্ঘ নয় মাসের ব্যাপক রক্তপাত ও লাখ লাখ শহীদের প্রাণের বিনিময়ে অবশেষে পাকিস্তানিদের নিশ্চিত পরাজয় ঘনীভূত হয়। সারা দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় যখন দ্বারপ্রান্তে, তখনই হানাদার বাহিনী বেপরোয়া হয়ে ওঠে। স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার তারা বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে এবং বাংলাদেশের সর্বস্তরের জনগণের ওপর নিপীড়নের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।

১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়ের মাত্র দুদিন পূর্বে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অসংখ্য শিক্ষাবিদ, পণ্ডিত, দার্শনিক, গবেষক, বুদ্ধিজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, সমাজসেবী, সংস্কৃতিসেবী, চলচ্চিত্র, নাটক ও সংগীতের সঙ্গে জড়িত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, কবি ও সাহিত্যিকদের চোখ বেঁধে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। অতঃপর অমানবিক নির্যাতনের পর তাদেরকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।

আসলে স্বাধীন বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করার হীন চক্রান্তে পরিকল্পিতভাবেই সেই হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ঢাকা শহরের মিরপুর, রায়েরবাজারসহ বিভিন্ন স্থানের গণকবরে দেশের নিরপরাধ পেশাজীবী ও বুদ্ধিজীবীদের ক্ষতবিক্ষত লাশ পাওয়া যায়।

১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের পর শহীদদের নিকটাত্মীয়রা মিরপুর ও রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে তাদের স্বজনের মৃতদেহ শনাক্ত করেন। অনেকে চিরতরে নিখোঁজ হয়ে যান, যাদের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। ঠিক তেমনি অনেক মায়ের সন্তান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি।

হানাদার বাহিনী কর্তৃক ধরে নিয়ে যাওয়া বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে উদ্ধারকৃত অনেকের চোখ ও হাত-পা বাঁধা রক্তাক্ত দেহে ছিল আঘাতের চিহ্ন। কারো কারো শরীরে একাধিক গুলি এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে জবাইয়ের মাধ্যমে অনেককে হত্যা করা হয়েছিল। দেশের সেসব শিক্ষিত সুশীল সমাজ ও বুদ্ধিজীবীদের নির্মমভাবে হত্যাযজ্ঞের পূর্বে কীভাবে তাদের প্রতি পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়েছিল, তার আলামত ও তথ্য পাওয়া যায়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের নিরপরাধ সাধারণ জনগণের ওপর নির্মম অত্যাচার, নিপীড়ন এবং নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ এবং বিভীষিকাময় হত্যালীলা সংঘটিত করার মধ্য দিয়ে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা চিরঘৃণিত ও ধিক্কৃত।
১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসে উল্লসিত ও আনন্দিত হওয়ার পাশাপাশি আমরা সেইসব শহীদ বুদ্ধিজীবীর কথা শ্রদ্ধাবনত চিত্তে মনে করে ভারাক্রান্ত হয়ে যাই। তাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি এবং তাদের আত্মার শান্তি কামনা করি।

১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। বাংলাদেশে জাতীয়ভাবে বিপুল ভাবগাম্ভীর্য ও শ্রদ্ধাঞ্জলির মাধ্যমে দিবসটি পালন করা হয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময়কার শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবার-পরিজনের কথা আমরা কতটুকু মনে রাখি। বরং দুঃখজনকভাবে উল্লেখ করতে হয়, স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত কোনো সরকারের আমলেই শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের চূড়ান্ত তালিকা প্রণয়ন এবং নিরপেক্ষভাবে তাদের পরিবারের সঠিক পরিসংখ্যান নিরূপণ করা হয়নি। আরও বেশি বেদনাদায়ক হলো, অনেক শহীদ পরিবারের খোঁজও রাখা হয়নি। তারা এবং অনেক মুক্তিযোদ্ধা অবহেলিত হয়েছেন। রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।

স্বাধীনতার পর দীর্ঘ ৫০ বছরে ক্ষমতার অনেক পালাবদল ঘটেছে। রাষ্ট্রক্ষমতার স্বার্থে এবং রাজনীতির গণ্ডির মধ্য দিয়ে যতটুকু না করলেই নয় (!) দায়সারাভাবে ততটুকুই পালন করা হয়ে থাকে। প্রকৃতার্থে এখনো সকল শহীদ পরিবারের প্রতি সমানভাবে মর্যাদা প্রদর্শন করা হয়নি।
দুঃখজনক হলেও সত্য, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার পর শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের অনেক পরিবারের জীবনে নেমে এসেছে অন্ধকার। স্বামীহারা বিধবা স্ত্রী, সন্তানহারা মা অথবা পিতা-মাতা হারানো সন্তান দুঃখ-কষ্ট, অভাব-অনটনে অনেকে পথের ভিখারিতে পরিণত হয়েছেন। অনেকে পাকিস্তানিদের নির্মমতা ও পাশবিকতার শিকার হয়েছেন। পাগল হয়ে গেছেন। কোথাও কোথাও শহীদ পরিবারের সদস্যরা পুষ্টিকর খাদ্য ও চিকিৎসার অভাবে অকালে প্রাণ হারিয়েছেন।

স্বাধীনতার পর কিছুসংখ্যক শহীদ পরিবারকে সম্মান প্রদর্শন করা হয়নি। সত্যি বলতে কি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অনেকে অবহেলার শিকার হয়েছেন। শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের মধ্যে যারা কিছুটা সচ্ছল ছিলেন, সেসব শোকগ্রস্ত পরিবারের বিধবা স্ত্রী কিংবা মা-বোন শোককে শক্তিতে পরিণত করে সরকারি আনুকূল্য ছাড়াই সংসারকে টিকিয়ে রাখেন। তারা অনেক দুঃখ-কষ্ট ও কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে তাদের সন্তানকে মানুষ করেন। মুক্তিযুদ্ধে সেসব পরিবারের অপরিসীম ত্যাগ এবং যারা কালের গর্ভে হারিয়ে গেছেন (!) তাদের পরিবারের প্রতি ন্যূনতম সম্মান প্রদর্শন করা হয়নি। এমনটি দুঃখজনক ও গ্লানিকর।

অথচ লাখ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। এটা কোনো সুশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রনীতির সংজ্ঞায় পড়ে না। এ প্রসঙ্গে প্লেটোর একটি বিখ্যাত উক্তি মনে পড়ে। প্লেটো বলেছেন, ‘স্বাধীনতা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের গৌরব। সুতরাং, একমাত্র গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই স্বাধীন মানুষেরা বসবাসের ইচ্ছা করবে।’

তিক্ত হলেও সত্যি, স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত ক্ষমতাবানরা আরও বেশি ক্ষমতাশীল হয়েছে। সুশীল রাজনীতির পরিবর্তে রাজনীতিতে একধরনের উগ্র, উৎকট শক্তি বখাটেপনার উন্মেষ ঘটেছে। ক্ষমতাসীনদের আত্মীয়স্বজন, চাটুকার শ্রেণি সমাজের মোড়ল সেজে বসেছে এবং রাতারাতি বিত্তবান হয়েছে। এ ছাড়া চোর-বাটপার, স্বাধীনতাবিরোধী, তোষামোদকারী এমনকি দাগী সন্ত্রাসী রাঘববোয়াল বনে গেছে। সারা দেশে দুর্নীতির সয়লাব এবং কালো টাকার বদৌলতে অনেকে হয়ে উঠেছে আঙুল ফুলে কলাগাছ। আমাদের মনে রাখা দরকার, স্বাধীন রাষ্ট্র্রে জনগণের মৌলিক নাগরিক অধিকার না থাকলে স্বাধীনতার মূল্য থাকে না এবং তা অর্থহীন হয়ে যায়। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে সরকারের বিগত দিনের মূল্যায়নে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি যতটা বেড়েছে, তা প্রশংসনীয়। কিন্তু এটাও সত্যি, সারা দেশে দুর্নীতি ও অপরাধপ্রবণতা বেড়ে গেছে আশঙ্কাজনকভাবে। বখাটেপনা, সামাজিক অবক্ষয় ও পাশবিকতার পরিবৃদ্ধি ঘটেছে। সমাজ থেকে সম্মানবোধ হ্রাস পেয়ে উগ্রতা ও নির্দয় আচরণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কুসংস্কারের অক্টোপাসে বেড়ে গেছে প্রকৃত ধর্মের অবমাননা, উন্মাদনা, ফ্যাসিবাদী কর্মকাণ্ড ও উগ্র মৌলবাদ।
সমাজে চেপে থাকা বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে সমতার ভিত্তিতে প্রত্যেকের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের এবং সচেতন নাগরিকদের। আমরা যেন সেই দিকটির ওপর গুরুত্ব প্রদান করি।

স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উদ্্যাপন ও সুবর্ণজয়ন্তীতে মুক্তিযুদ্ধের সেই সব ভয়াল স্মৃতিময় দিনগুলোর কথা মনে করলে হৃদয়-মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এবং মহান শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে সরকারের আকুল আবেদন। নিরপেক্ষভাবে সারা দেশের শহীদ বুদ্ধিজীবী ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সঠিক পরিসংখ্যান প্রণয়নের মাধ্যমে তাদের সহায়তা করা হোক এবং তাদের প্রতি যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে রাষ্ট্রীয়ভাবে সকল মুক্তিযোদ্ধার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হোক। তবেই মুক্তিযুদ্ধের সকল শহীদ এবং শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের প্রতি আমাদের দায় কিছুটা হলেও শোধ হবে।

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category