আমি তখন অনার্স এ পড়ি। আমি যে বাসায় থাকতাম সেই বাড়ির ছেলে নিলয় ক্লাস নাইনে পড়তো। ছেলেটির মা ছিল না। তাই তাকে দেখলেই আমার মায়া হত। তাকে সান্ত্বনা দিতাম, পড়ার কথা বলতাম ।
একদিন কলেজে যাবার সময় জানালা দিয়ে দেখতে পেলাম সে ছটফট করছে। মাথার চুল গুলো দুহাতে টানছে। বললাম তোমার কি হয়েছে?
সে কথা বলতে পারছে না। দুচোখ দিয়ে পানি ঝরছে। আমি তাড়াতাড়ি করে রুমে গেলাম, কপালে হাত দিয়ে দেখলাম অনেক জ্বর। তার বাবাকে ফোন দিলাম, ঔষধ খাইয়ে মাথায় পানি দিলাম। কিন্তু জ্বর কমছে না। তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি আমি।
নিলয় আমার হাতটা তার মাথা থেকে টেনে নিয়ে বুকে রেখে বললো তোমাকে আমার একটা কথা বলা হয়নি। আমি বললাম কি কথা। নিলয় বললো আমি তোমাকে ভীষন ভালবাসি -আমার জীবনের থেকেও। যদি বিশ্বাস না কর তবে আমার মৃত্যু ছাড়া আর কোন পথ খোলা থকবে না।
আমি বললাম চুপ কর, এসব কথা পরে হবে। তুমি অসুস্থ ,আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি তোমার, তুমি ঘুমাও। নিলয় বললো, আগে বলো, তুমি আমাকে আজীবন ভালবাসবে, কখনও ভুলবে না, বলেই কাঁদতে শুরু করলো।
আমি সেই মুহূর্তে তাকে শান্ত রাখার জন্য কথা দিলাম। সে বললো এবার আমি মরেও সুখ পাব নীলিমা ।
এবার আমার হাতটা জোড়ে চিপে ধরলো নিলয়। অসুস্থ শরীরে যে এত শক্তি থাকে তা আমার জানা ছিল না।
এরই মধ্যে নিলয়ের বাবা ঘরে আসে। আমি বার বার লজ্জায় আমার হাত টা টানতে শুরু করলাম। কিন্তু কিছুতেই নিজেকে আলাদা করতে পারলাম না।
নিলয় বললো, আমাকে কথা দাও, আজীবন এভাবে আমাকে ভালবাসবে, আমাকে মনে রাখবে। আমি তার অসুস্থতা আর অস্থিরতা দেখে কথা দেই।
এরপর চাচা এসে আমার হাত টি ছাড়িয়ে নিল। আর আমাকে বললো চলে যেতে।
আমি রুমে আসলাম আর এরপর দেখলাম নিলয়কে হাসপাতাল এ নিয়ে যেতে।
এরই মাঝে তিনদিন চলে গেছে। আমি তাকে দেখতে হাসপাতাল যাই। কিন্তু চাচা আমাকে নিলয়কে দেখতে দেয়নি। আমি কান্না চোখে রুমে আসি।
পরে শুনি নিলয় বেঁচে নেই।
আমি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। বার বার তার কথাগুলি আমার মনকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিল। আমার হাতের দিকে তাকালাম, এখনও আমার হাতটি লাল হয়ে আছে নিলয়ের স্পর্শে।
মনে হলো এখন ও সে আমার হাতটি চিপে ধরে আছে তার বুকের সাথে জড়িয়ে । দুচোখের পানিতে ভিজে যাচ্ছে আমার শরীরের কাপড় । বার বার তাঁর দেওয়া আমার হাতের আঘাতটিতে চুমু দিচ্ছি। ভালবাসা যদি এলই জীবনে তবে এত অল্প সময়ের জন্য কেন?
সেদিন সারাদিন আর রুম থেকে বের হয়নি। আমার জীবনের সমস্ত কান্নাগুলো আমি কেঁদেছিলাম সেদিন।
পরের দিন সকালে নিলয়ের কবরে যাই আমি। তার কবরে আমার ভালবাসার চোখের দুফোটা জল ফেলি আমি।
এভাবে আজো প্রতিদিন আমি যাই তার কবরে আমার ভালবাসার জল ফেলতে। আর চুপি চুপি বলি আমি আজো ভালবাসি শুধু তোমাকে।
তোমার স্পর্শ আমার হাতে আজো অনুভব করি ।
তোমার বুকের সেদিনের অস্থিরতায় আমি আজো কষ্ট পাই।