বেনাপোল বন্দরে ট্রাক লোডিং স্লিপের নামে যশোর-বেনাপোল মহাসড়ক ও বেনাপোল বাইপাস সড়কে চলছে চাঁদাবাজির মহোৎসব। দেশের মহাসড়কে চাঁদাবাজি বন্ধে প্রশাসন কঠোর অবস্থানে থাকলেও, নানা কৌশলে এই চাঁদাবাজি দিন দিন বেড়েই চলেছে।
বাংলাদেশের সর্ব বৃহৎ বেনাপোল স্থল বন্দরে লোড আনলোডের জন্য আগত ট্রাক, পিকআপ, ক্যাভার্ডভ্যান সহ সকল পণ্যবাহী বাহন থেকে ১০০ টাকার লোডিং ¯িøপ দিয়ে এই চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। আর এই চাঁদা আদায় হচ্ছে ৬টি সংগঠনের নামে। সংগঠন গুলো হলোঃ-
১। বেনাপোল ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি মালিক সমিতি, রেজিট্রেশন- ১২৬৭।
২। যশোর জেলা ট্রাক, ট্যাংকলরী, ট্রাক্টর ও কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতি, রেজিট্রেশন- ১২৪৭।
৩। যশোর আন্তঃ জেলা ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়ন, রেজিট্রেশন- ২৪০৬।
৪। বাংলাদেশ কাভার্ডভ্যান ট্রাক পণ্য পরিবহন মালিক এসোসিয়েশন-ঢাকা।
৫। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন খুলনা বিভাগীয় আঞ্চলিক কমিটি।
৬। বেনাপোল নাইট গার্ড।
সরেজমিনে বেনাপোল বাইপাস সড়কের প্রাণী সম্পদ অফিসের সামনে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিদিন সকাল হতে রাত্র পর্যন্ত চলছে এই ৬টি সংগঠনের নামে ১০০ টাকার ট্রাক লোডিং স্লিপ এর চাঁদা আদায়। সাংবাদিকরা চাঁদা তোলার বিষয়ে বৈধতা ও ছবি তুলতে চাইলে সংগঠনের লোকেরা সাংবাদিকদের উপর চড়াও হয়ে ওঠে। চাঁদা আদায়ের ফলে বাইপাস সড়কে সৃষ্টি হচ্ছে ব্যপক জ্যাম। এছাড়া বেনাপোল কাস্টমস হাউসের সামনে ট্রাক লোডিং স্লিপ চেকিং সহ স্লিপ বিহীন ট্রাক গুলো থেকে টাকা আদায় করছে এই সংগঠন।
২০১৯ সালে হাইওয়ে পুলিশের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, দেশের মহাসড়কগুলো থেকে প্রতিদিন নূন্যতম ২৩ লাখ ৩৯ হাজার ৯৫ টাকা চাঁদা তোলা হচ্ছে। এ টাকা আদায় করছে পরিবহণ মালিক ও শ্রমিক নামধারী ২১৫টি সংগঠন, যার নেতৃর্তে¦ রয়েছেন সরকারি দলের বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের প্রভাবশালী নেতারা।
বেনাপোল বন্দরে পণ্য লোড আনলোড করতে আসা একাধিক ট্রাক ড্রাইভারের সাথে ১০০ টাকার লোডিং স্লিপের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে তাদের মুখে হতাশার সহিত বেরিয়ে আসে নানা ক্ষোভ। চালকরা জানান, বেনাপোলে ঢুকেই শুরু হয় চাঁদা দেওয়ার উৎসব বেনাপোল পৌর ট্রাক টার্মিনালের নামে দিতে হয় ১০০ টাকা চাঁদা, যার কোন সুবিধাই আমরা ভোগ করিনা। তার একটু সামনে আসলেই ট্রাক লোডিং স্লিপের নামে দিতে হয় আরও ১০০ টাকা চাঁদা। মহাসড়কে এমন হাজারো টাকা খরচ করে দিন শেষে মহাজনকে টাকা দিয়ে খুশী করতে পারিনা। না ঘুমিয়ে হাড়ভাঙা কষ্ট করে দিন শেষে আমাদের প্রাপ্তির হিসাবটা পরিবার নিয়ে জোটে দুমুঠো ডাল ভাত। কোথাও চাঁদা দিতে না চাইলে সংগঠনের লোকেরা ক্ষেপে এসে গাড়ীর গ্লাস ভাংচুর সহ গায়ে পর্যন্ত হাত দেই। এসকল ভয়ে আমরা নিরুপায় হয়ে চাঁদা দিতে বাধ্য হচ্ছি মহাসড়কে।
২০১৫ সালের ডিসেম্বরে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে এ ধরনের চাঁদা আদায় না করা এবং এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় কমিশনার, পুলিশ কমিশনার, ডিআইজি, জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে চিঠি দেওয়া হলেও অবস্থার যে কোনো পরিবর্তন হয়নি তা পরিলক্ষিত।
বর্তমান দেশে অধিকাংশ চাঁদাবাজির ঘটনা যেহেতু ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী ও ক্যাডার বাহিনীর ছত্রছায়ায় ঘটছে, তাই রাজনৈতিক নেতৃত্বের উদ্যোগ ও আন্তরিকতা ছাড়া শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে এ অরাজকতা বন্ধ করা সম্ভব নয়। অবশ্য এ ক্ষেত্রে সড়ক-মহাসড়কে চাঁদাবাজির সঙ্গে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আইন শৃঙ্খলা বাহীনির নামও বেশ স্পষ্টভাবেই যুক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে। কাজেই দেশের সড়ক-মহাসড়কে চলাচলকারী যানবাহন গুলোকে চাঁদাবাজি থেকে সুরক্ষা প্রদানে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের বিকল্প নেই।
ট্রাক লোডিং স্লিপে চাঁদা আদায়ের বৈধতা সম্পর্কে বেনাপোল ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি মালিক সমিতির সভাপতি আতিকুজ্জামান সনি বলেন, দেশের অন্যান্য বন্দরে তো ট্রাক লোডিং স্লিপে ৩০০-৪০০ শত টাকা নেই, সে খানে তো আমরা মাত্র ১০০ টাকা করে নিচ্ছি।
চাঁদা আদায় এর বিষয়ে নাভারণ সার্কেল এ এসপি জুয়েল ইমরান বলেন, বেনাপোল বাইপাস সড়কে ট্রাক লোডিং স্লিপে চাঁদা আদায়ের বিষয়টি আমার জানা ছিলো না। স্লিপের মাধ্যমে টাকা আদায় করা সম্পূর্ন অবৈধ। লোডিং স্লিপের নামে টাকা আদায় কে বা কারা করছে আমি আমার প্রশাসন পাঠিয়ে এখনি ব্যবস্থা গ্রহন করছি।
সারাদেশে ট্রাক মালিক সমিতি ও শ্রমিক নেতা নামধারী ব্যক্তি কিংবা সংগঠন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য সহ যে কেউ চাঁদাবাজির মতো বেআইনি কর্মকান্ডে লিপ্ত হলে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সরকার এবং প্রশাসন কঠোর হবে, এটাই ভুক্তভোগী সহ সাধারণ জনগণের প্রত্যাশা।